Connect with us
ফুটবল

কোটি কোটি টাকা আয় করেও যে কারণে দেউলিয়া হচ্ছেন ফুটবলাররা

Top football stars who went bankrupt
মারাদোনা-রোনালদিনহোরা ক্যারিয়ার শেষে আর্থিকভাবে কঠিন অবস্থায় পড়েন। ছবি- সংগৃহীত

অনেকের ধারণা ফুটবলারদের জীবন মানেই অর্থ-বিত্ত আর জৌলুশে ভরপুর। দামি গাড়ি, বাড়ি আর বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের অনুসারী। সুখে শান্তিতে কাটে তাদের সারাটা জীবন৷ তবে ধারণাটি সর্বাংশে সঠিক নয়। ক্যারিয়ারের শুরুতে কাড়ি কাড়ি টাকা-পয়সা অর্জন করলেও অনেক ফুটবলাররা একসময় হয়েছেন দেউলিয়া।

ডিন উইন্ডাসের কথাই ধরা যাক। বিশ্বসেরাদের কাতারে না থাকলেও উইন্ডাস ছিলেন দারুণ এক স্ট্রাইকার। তার ১৮ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে খেলছেন ইংল্যান্ডের চারটি ডিভিশনে। এর মধ্যে খেলেছেন প্রিমিয়ার লিগে ব্র্যাডফোর্ড সিটি, মিডলসব্রো এবং হাল সিটির হয়ে। স্কটিশ প্রিমিয়ার লিগে অ্যাবারডিনের হয়েও মাঠ মাতিয়েছেন উইন্ডাস। ইংলিশ ফুটবলে নিজের উত্থানের সময়ে ভালোই আয় করেছিলেন এই স্ট্রাইকার। কিন্তু ২০০৯ সালে অবসর নেওয়ার মাত্র সাত বছরের মধ্যে উইন্ডাস কার্যত নিঃস্ব হয়ে পড়েন। বিবাহ বিচ্ছেদ, চলচ্চিত্রে ভুল বিনিয়োগের কারণে ১ লাখ ৬৪ হাজার পাউন্ড তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে খালি হয়ে যায়৷ নিজের সর্বস্ব হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে যান উইন্ডাস।

ক্রীড়াভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘দি অ্যাথলেটিক’-কে ডিন উইন্ডাস বলেন,“আপনি অবসর নেন কিংবা ফুটবলকে বিদায় জানান। এটা যথেষ্ট কঠিন। এর উপরে দেউলিয়াত্ব সবকিছুকে আরও কঠিন করে তোলে। মানসিক চাপ আমাকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছিল।”

“আমি একবার একটি পিৎজা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম, তখন সেখানে এক দম্পতি অর্ডার করছিল, আমি লোকটার ঠোঁট পড়ে বুঝি, সে বলছে, ‘ও তো ডিন উইন্ডাস, সে তো দেউলিয়া হয়ে গেছে।’ ব্যাপারটা খুব লজ্জাজনক ছিল।”

আরও পড়ুন:

» আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল– কার ঝুলিতে কত শিরোপা?

» কেন এত ফুটবলাররা ১০ নম্বর জার্সি পরতে চায়?

তবে উইন্ডাস একা নন। ইংল্যান্ডের সাবেক তারকা ডেভিড জেমস, ওয়েস ব্রাউন ও লি হেনড্রিও তাদের গৌরবময় ক্যারিয়ারের পরে দেউলিয়া ঘোষিত হয়েছেন। ব্রিটিশ রাজস্ব বিভাগ (HMRC) গত বছর লিভারপুল ও ইংল্যান্ডের সাবেক স্ট্রাইকার এমিল হেসকির বিরুদ্ধে ১৬ লাখ পাউন্ডের বকেয়া কর আদায়ের মামলা করেছিল।

গত মাসে ইংল্যান্ডের সাবেক খেলোয়াড় ট্রেভর সিনক্লেয়ার ৩৬ হাজার পাউন্ড কর দেনা এড়িয়ে যাওয়ার পর দেউলিয়া হন। একই সময়ে, আরেক সাবেক ইংল্যান্ড তারকা শন রাইট-ফিলিপসের বিরুদ্ধেও দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করে ব্রিটিশ রাজস্ব বিভাগ। তারা সবাই কেবল দেউলিয়াত্বের সাম্প্রতিক উদাহরণ। এর আগেও ফুটবলারদের দেউলিয়া হওয়ার অসংখ্য নজির দেখা গেছে।

কেন এত ফুটবলার আর্থিক সংকটে পড়ে?

কিংবদন্তি দিয়েগো মারাদোনা এমনকি রোনালদিনহোর মতো নামকরা তারকাদের ক্যারিয়ার শেষে আর্থিকভাবে কঠিন অবস্থায় পড়তে হয়েছে। প্রত্যেক ফুটবলারদের আর্থিক সংকটের পেছনে আলাদা গল্প থাকলেও কিছু সাধারণ বিষয় সবসময় চোখে পড়ে৷ এর মধ্যে অন্যতম ভুল জায়গায় বিনিয়োগ, বিবাহবিচ্ছেদের ব্যয় সামলানো, কিংবা নিয়ন্ত্রণহীন বিলাসী জীবনযাপন।

২০১৭ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ জয়ী ইংল্যান্ড দলটার কথা অনেকেরই মনে আছে৷ ফাইনালে স্পেনকে ৫-২ গোলে হারানোর ম্যাচে ফিল ফোডেন দিয়েছিলেন জোড়া গোল। বর্তমানে ফোডেন খেলছেন ম্যানচেস্টার সিটিতে। সেই দলে আরও ছিলেন মার্ক গুয়ে, জেডন সাঞ্চো, এমিল স্মিথ রো, কনর গ্যালাআর, অ্যাঞ্জেল গোমেস, মর্গান গিবস-হোয়াইট এবং ক্যালাম হাডসন-ওডোইয়ের মতো বর্তমান ক্লাব ফুটবলের তারকারা। প্রত্যেকেই ক্লাবের জার্সিতে মাঠ মাতাচ্ছেন, অনেকে খেলেছেন জাতীয় দলেও৷

আরও পড়ুন:

» যেভাবে অলিম্পিকে হবে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট

» যে কারণে বাংলাদেশ সফর স্থগিত করেছে ভারত

তবে ওই দলের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন গোলরক্ষক কার্টিস অ্যান্ডারসন। ম্যানচেস্টার সিটি অ্যাকাডেমির এই গোলরক্ষক টুর্নামেন্টে ছয়টি ম্যাচে খেলেছিলেন। পরে ২০২২ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে পেশাদার ফুটবল ছেড়ে দেন অ্যান্ডারসন। এরপর উইকম ওয়ান্ডারার্সে দুই বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষেও কোনো প্রথম দলীয় ম্যাচে না খেলতে পারা এবং নন-লিগ ক্লাবে ধার দেওয়ার অভিজ্ঞতার পর তিনি ফুটবলের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তখন তিনি ফিন্যান্সিয়াল প্ল্যানিংয়ে ডিপ্লোমা করার সিদ্ধান্ত নেন। যার মাধ্যমে তার ক্যারিয়ার মোড় নেয় ভিন্ন দিকে।

অ্যান্ডারসন বলেন,“আমরা যখন ১৬-১৭ বছর বয়সে ছিলাম, তখন ক্লাব থেকে আমাদের মদ্যপান, জুয়া—এইসব বিষয়ে সতর্ক করা হতো। কিন্তু আমি মনে করি না কখনো অর্থ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কাউকে আসতে দেখেছি। আমার গোলরক্ষক কোচ মাঝেমধ্যে কিছু বলতেন। তিনি আসলে বাবা-সুলভ মানুষ ছিলেন, সাবধান করতেন। কিন্তু ক্লাবের পক্ষ থেকে কখনো কিছু ছিল না। কারণ এটি একটু স্পর্শকাতর বিষয়।”

বর্তমানে অ্যান্ডারসন প্রিমিয়ার লিগ ও ইএফএলের বিভিন্ন ক্লাবে গিয়ে ফুটবলারদের অর্থ ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করেন। তার অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, অনেক ফুটবলারই জানেন না কীভাবে তাদের অর্থের সঠিক ব্যবহার করতে হয়।

অ্যান্ডারসন বলেন, “যেসব ফুটবলার আমাদের কথায় আগ্রহী হয় তারা সাধারণত একটু বেশি বয়সী। ২৮ বা ২৯ বছরের৷ কিন্তু তখন আসলে সময় প্রায় ফুরিয়ে গেছে। অথচ তারা যদি ২১ বছর বয়সেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিত, জীবনটা অনেক সহজ হতো।”

আয়াক্সের সাবেক একাডেমি খেলোয়াড় সাউফিয়ান দাফির কথাও অনেকটা মিল রয়েছে অ্যান্ডারসনের সঙ্গে। দাফি বর্তমানে ‘স্পোর্ট লিগেসি’ নামে একটি আন্তর্জাতিক প্লেয়ার ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা।

তিনি বলেন,“খেলোয়াড়রা যখন মাসিক বেতন পায় তখন সে অনুযায়ী লাইফস্টাইল তৈরি হয়। কিন্তু একসময় সেটা বন্ধ হয়ে গেলে গ্যাপ তৈরি হয়। অনেক মানুষ বলেছে ফুটবলাররা বোকা, তারা সব টাকা উড়ায়। আমি সেই ধারণা বদলাতে চেয়েছি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ছোট বয়সে আর্থিক শিক্ষা দেওয়া।”

আরও পড়ুন:

» সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপে সবচেয়ে বেশি শিরোপা কার?

» টেস্টে ‘স্টপ ক্লক’, ক্রিকেটে আরও যত নিয়ম আনল আইসিসি 

স্পোর্টস লিগেসির দুবাই শাখার অ্যাম্বাসেডর রায়ান ব্যাবেল বলেন,“এই খেলা আপনাকে আর্থিক সচেতনতা শেখায় না। আপনার নিজের দায়িত্ব টাকা সামলানো। অধিকাংশ ফুটবলার কম বয়সে পেশাদার হয়, তাদের পড়ালেখা সম্পূর্ণ হয় না। ফলে আর্থিক জ্ঞানের অভাব থেকে অনেক ভুল হয়। ফুটবলাররা অনেক সময় চলন্ত এটিএমের মতো হয়ে যায়, তাদের আশেপাশের লোকজন সেটা উপভোগ করে। কিন্তু টাকা ফুরিয়ে গেলে, সেই মানুষগুলোও অদৃশ্য হয়ে যায়।”

সাবেক ফুটবলারদের এভাবে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। ২০১৩ সালে প্রাক্তন ফুটবলারদের সংগঠন ‘XPro’ দাবি করেছিল, ৫ বছরের মধ্যে প্রতি ৫ জনে ৩ জন ফুটবলার দেউলিয়া হন। তবে এই সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। প্রফেশনাল ফুটবলার’স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রধান গর্ডন টেলর বিবিসি-কে জানিয়েছিলেন, এই সংখ্যা ১০-২০ শতাংশ।

তবে সংখ্যাটা যাই-হোক কোটি কোটি টাকা আয় করা সত্ত্বেও অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন, বিবাহবিচ্ছেদে খরচ, ভুল জায়গায় বিনিয়োগসহ নানা কারণে দেউলিয়া হয়ে পড়েন ফুটবলাররা।

ক্রিফোস্পোর্টস/২৩জুলাই২৫/টিএইচ/বিটি

Crifosports announcement
Click to comment

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Focus

More in ফুটবল