Connect with us
ক্রিকেট

বিশ্বসেরা সাকিব আল হাসানের কীর্তিনামা

shakib al hasan
বাংলার ক্রিকেটের ধ্রুব সাকিব আল হাসান। ছবি- সংগৃহীত

২০০৬ সালের ৬ আগস্ট জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক হলো হালকা পাতলা গড়নের এক যুবকের। উঠে এসেছেন বিকেএসপি থেকে। যার জার্সি নম্বর দেওয়া হলো ৭৫। ধীরে ধীরে পারফর্ম্যান্সের অটুট ধারাবাহিকতার অসীম সীমায় নিজেকে তুলে নিয়ে যেতে শুরু করলেন। ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার।

কাঁপাতে লাগলো বিপক্ষের ব্যাটিং লাইনআপ, ভাঙতে লাগলো পুরনো সব রেকর্ড। গড়তে লাগলো নতুন নতুন সব রেকর্ড। রেকর্ডের বইকে করতে লাগলেন এলোমেলো। নিজেকে তুলতে লাগলেন অনন্য উচ্চতায়। তিনি বাংলার ক্রিকেটের ধ্রুব বাবা-মায়ের আদরের ফয়সাল এবং ক্রিকেট বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান।

বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮৭ সালের ২৪ মার্চ খুলনা বিভাগের মাগুরা জেলায়। বাবা মাসুর রেজা ছিলেন একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি নিজেও খুলনা বিভাগের হয়ে ফুটবল খেলেছেন। অন্যদিকে সাকিবের মা শারমিন বেগম ছিলেন একজন গৃহিণী। ছোট বেলা থেকেই সাকিব ছিলেন খেলা-পাগল। তার খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ এবং দক্ষতা এতটাই ছিলো যে গ্রাম থেকে গ্রামে তাকে ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া হতো।

এমনই এক ম্যাচে এক আম্পায়ারকে অভিভূত করেন সাকিব। পরবর্তীতে মাগুরার ইসলামপুর পাড়া ক্লাবের সঙ্গে অনুশীলন করার সুযোগ পান। সাকিব তার স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক ব্যাটিং ও দ্রুতগতির বোলিং অব্যাহত রাখেন, সেইসঙ্গে প্রথমবারের মতো স্পিন বোলিং নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন— সফলও হন। ফলস্বরূপ, ইসলামপুর দলে খেলার সুযোগ পান এবং প্রথম বলেই উইকেট তুলে নেন।

আরও পড়ুন :

» সাকিবের অভাব পূরণের কৌশল জানালেন জুনিয়র সাকিব

» বাংলাদেশের এমন হারে কষ্ট পেয়েছেন হাথুরুসিংহে

» সাকিব আল হাসান: যার কাছে শেষ বলে হয়তো কিছু নেই!

সত্যিকারের ক্রিকেট বল দিয়ে এটাই ছিল তার প্রথম করা বল, এর আগ পর্যন্ত তিনি টেপ টেনিস বল দিয়েই খেলতেন। তিনি বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ছয় মাস প্রশিক্ষণ নেন এবং ২০০৪ সালে ১৭ বছর বয়সে জাতীয় লীগে খেলার জন্য খুলনা দলে নাম জমা দেন।

মাত্র পনের বছর বয়সেই সাকিব অনূর্ধ্ব​-১৯ দলে খেলার সুযোগ পান। ২০০৫ সালে অনূর্ধ্ব​-১৯ ত্রি-দেশীয় টুর্নামেন্টের ফাইনালে (অপর দুটি দেশ ছিল ইংল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা) মাত্র ৮৬ বলে সেঞ্চুরি করেন এবং তিনটি উইকেট নিয়ে দলকে জেতাতে সহায়তা করেন। ২০০৫ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে সাকিব অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ১৮টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন। ৩৫.১৮ গড়ে তিনি মোট ৫৬৩ রান সংগ্রহ করেন এবং ২০.১৮ গড়ে নেন মোট ২২টি উইকেট।

shakib al hasan

এরপরই ২০০৬ সালের জিম্বাবুয়ে সফরে সাকিব প্রথমবারের মত বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পান। একই ট্যুরে ওয়ানডে অভিষেক হয় ফরহাদ রেজা ও মুশফিকুর রহিমের। সাকিব ও রেজাকে তখন দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় তরুণ প্রতিভা হিসেবে গণ্য করা হতো। সকল ডিপার্টমেন্টে যাদের দক্ষতা অসামান্য।

তৎকালীন প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ বলেছিলেন, ‘তরুণদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। এখনই সময় তাদের আন্তর্জাতিক লেভেলে খেলার সুযোগ করে দেওয়া।’

একদিনের আন্তর্জাতিক খেলায় সাকিবের অভিষেক হয় ৬ আগস্ট। তার প্রথম শিকার হন এলটন চিগুম্বুরা। ৩৯ রানে ১ উইকেট— এই ছিল তার সেদিনকার বোলিং ফিগার। ব্যাট হাতে তিনি ৩০ বলে ৩০ রান করে অপরাজিত থাকেন।

শাহরিয়ার নাফিস সেদিন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি করে বাংলাদেশকে ম্যাচ জেতাতে ভূমিকা রাখেন। ম্যাচটি ছিল সিরিজের শেষ ম্যাচ, যাতে জিম্বাবুয়ে ৩-২ ব্যবধানে জয়ী হয়।

একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে সাকিব, ফরহাদ রেজা ও মেহরাব হোসেন জুনিয়র বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। ফলে, বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়ের সংখ্যা ২০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ২৩— এ।

এরপর ওই বছরেরই ২৭ নভেম্বর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয় সাকিবের। এরপর আসে ২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। ওয়েস্ট ইন্ডিজে আয়োজিত ২০০৭ ক্রিকেট বিশ্বকাপ এ হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বাধীন ১৫ জনের বাংলাদেশ স্কোয়াডে ডাক পান এই তরুণ ক্রিকেটার। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় পর্বে যেতে সক্ষম হয় এই দল এবং ৭ নম্বর টিম হিসেবে টুর্নামেন্ট শেষ করে বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন :

» প্লেয়ার্স বায়োগ্রাফি: সাকিব আল হাসান

» দশ বছরের দাম্পত্য জীবন, যা বললেন সাকিব আল হাসান

» আকস্মিক বিদায়ের ঘোষণায় যা বলেন সাকিব

সে বছরই মে মাসে দুটি টেস্ট ও তিন ওয়ানডের এক সফরে বাংলাদেশে আসে ভারত। মে মাসের ১৮ তারিখ সাকিবের টেস্ট অভিষেক হয় ভারতের বিপক্ষে। অভিষেকটা ঠিক স্বপ্নের মত হয়নি তার জন্য। এক ইনিংস ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে এই অলরাউন্ডার ২৭ রান করেন এবং ১৩ ওভার বল করে উইকেট-শূন্য থাকেন, ম্যাচটি ড্র হয়। ভারত টেস্ট সিরিজ জেতে ১-০ ব্যবধানে। সিরিজ শেষে ডেভ হোয়াটমোর দলের কোচের দায়িত্ব ছেড়ে দেন এবং হাবিবুল বাশারের স্থলাভিষিক্ত হন মোহাম্মদ আশরাফুল।

রেকর্ডের মালা গেঁথে রেকর্ডবুককে তিনি করে রেখেছেন এক অনন্য রেকর্ডফুলের বাগান। যেখানে শোভিত হচ্ছে তার রেকর্ডগুলো। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হিসেবে আত্মপ্রকাশে তিনি গড়েছেন অনন্য সবকীর্তি।

ইতিহাসের প্রথম এবং একমাত্র ক্রিকেটার সাকিব, যিনি আইসিসির তিন ফরম্যাটেই অলরাউন্ডারদের খেলোয়াড় র‍্যাঙ্কিং-এ ১ নম্বর অলরাউন্ডার হন। তিনিই একমাত্র অলরাউন্ডার যিনি করেছেন ৭০০০-এর বেশি রান এবং ৩০০-এর বেশি উইকেট নিয়েছেন। ওয়ানডেতে যে কোনো বাংলাদেশি জুটির জন্য যেকোনো উইকেটে সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ডে মাহমুদউল্লাহ সঙ্গে গড়েছেন এই কীর্তি (২২৪)।

সাকিবই দ্রুততম এবং পঞ্চম অলরাউন্ডার হিসেবে টেস্টে ৫৪ ম্যাচ খেলে ৩০০০ রান এবং ২০০ উইকেট পান এবং তিনি সবচেয়ে দ্রুততম এবং পঞ্চম অলরাউন্ডার হিসেবে ওয়ানডেতে ১৯৯ ম্যাচ খেলে ৫০০০ রান এবং ২৫০ উইকেট পান।

এছাড়াও তিনি পুরুষদের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ১০০ উইকেট এবং ১০০০ রান করা প্রথম অলরাউন্ডার। সাকিব টেস্টে দ্রুততম ৩০০০ রান এবং ২০০ উইকেট দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচিত হন। সাকিব আল হাসানই দ্রুততম এবং চতুর্থ অলরাউন্ডার হিসেবে ওয়ানডেতে ২০২ ম্যাচ খেলে ৬০০০ রান এবং ২৫০ উইকেট পেয়েছেন।

সাকিব সবচেয়ে দ্রুততম, সর্বকনিষ্ঠ এবং সপ্তম ক্রিকেটার যিনি ওয়ানডেতে ১৫৬ ম্যাচে ৪০০০ রান এবং ২০০ উইকেট অর্জন করেছেন। সাকিবই প্রথম স্পিন বোলার এবং সামগ্রিকভাবে তৃতীয় খেলোয়াড় যিনি একক মাঠে ১০০ টিরও বেশি ওডিআই উইকেট নিয়েছেন (শেরে-ই-বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে) টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে একক মাঠে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়া এবং পুরুষদের টি-টোয়েন্টিতে দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় উইকেট শিকারি এবং স্পিন বোলার হিসেবে সর্বোচ্চ ১৪৯ উইকেট শিকার করেছেন তিনি।

ওয়ানডে বিশ্বকাপের ইতিহাসে একমাত্র ক্রিকেটার যিনি এক আসরেই ৬০০-এর বেশি রান এবং ১০টির বেশি উইকেট শিকার করেন। এছাড়াও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ৪৭টি উইকেট শিকার করছেন তিনি। ৫৯ ম্যাচ টেস্ট ক্রিকেটে দ্রুততম অলরাউন্ডার হিসেবে ৪০০০ রান এবং ২০০ উইকেট লাভ করেন। প্রথম বাংলাদেশি খেলোয়াড় যিনি ওডিআইতে ৩০০ উইকেট নেন এবং তৃতীয় অলরাউন্ডার হিসেবে ওডিআইতে ৬০০০ রান এবং ৩০০ উইকেটের ডাবল অর্জন করেছেন।

সাকিব আল হাসান ক্রিকেটের ইতিহাসে একমাত্র খেলোয়াড় যিনি প্রতিটি ফরম্যাটেই কমপক্ষে ৫ বার প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ১৪০০০-এর বেশি রান ও ৭০০টির বেশি উইকেট শিকার করেছেন।

সাকিবের অনবদ্য রেকর্ড ও কীর্তিগুলো কেমন ছিলো?

সাকিব ২০১১ সালের পর নিজের তৃতীয় সেঞ্চুরি করেন সফরকারী জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ওই ম্যাচে পাঁচ উইকেট তুলে নেন সাকিব। এছাড়াও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ২য় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে নিজের ক্যারিয়ারে ১৪ তম পাঁচ উইকেট প্রাপ্তির মাধ্যমে সাকিব সাকলাইন মুশতাক ও মাইকেল হোল্ডিংয়ের অর্জনকে পেছনে ফেলে রেকর্ডের পাতা পাল্টে দেন।

বাহাতি স্পিনার এনামুল হক জুনিয়রের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে একই টেস্টে দুবার পাঁচ উইকেট প্রাপ্তির অনন্য রেকর্ড গড়েন তিনি। প্রথম ইনিংসে ১৩৭ রান করেন এবং বল করে ৫/৮০ পান। পরবর্তীতে দ্বিতীয় ইনিংসে ৫/৪৪ পান। ওই ম্যাচে তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারও পান।

shakib al hasan

সাকিব তার কীর্তি সাম্রাজ্যে একাই মহারাজ (shakib al hasan)। ছবি- সংগৃহীত

সেই টেস্টে নাতসাই মুশাঙউইকে আউট করে সাকিব তার দশম উইকেট পূর্ণ করেন। সাকিবের সেঞ্চুরি ও দশ উইকেট প্রাপ্তির পূর্বে ১৯৮৩ সালে ফয়সালাবাদে ভারতের বিপক্ষে সর্বশেষ এ কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন পাকিস্তানি কিংবদন্তি ইমরান খান। এছাড়া একমাত্র অন্য খেলোয়াড় হিসেবে ইংল্যান্ডের ইয়ান বোথাম এ তালিকায় রয়েছেন। তারমধ্যে সাকিবই প্রথম স্পিনার। এছাড়াও এর আগে ১৯৯০ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে ওয়াসিম আকরাম তিন টেস্টের সিরিজে সেঞ্চুরিসহ তিনবার পাঁচ উইকেট পান। তারপরই সাকিবের এ অর্জন।

ধারাবাহিকভাবে পাঁচ উইকেট লাভের দিক দিয়ে সাকিবের অবস্থান পঞ্চম। তার সামনে আছেন সিডনি বার্নস, ক্ল্যারি গ্রিমেট, মুত্তিয়া মুরালিধরন, রিচার্ড হ্যাডলি।

এমন সব অসামান্য কীর্তি গড়ে বিশ্বসেরার খেতাবটা নিজেরই করে রেখেছেন বাংলার পোস্টারবয় এই কিংবদন্তি খেলোয়াড়। তার এই অসামান্য কীর্তিস্বরুপ তাকে বাংলাদেশের হয়ে খেলা সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শুধু তাই নয়, তিনি ইএসপিএন দ্বারা বিশ্বের ৯০তম বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ হিসেবে স্থান পেয়েছেন। তাই অনেকেই বলেন, সাকিব তার কীর্তি সাম্রাজ্যে একাই মহারাজ।

ক্রিফোস্পোর্টস/১অক্টোবর২০২৪/এসআর/এসএ

Click to comment

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Focus

More in ক্রিকেট