
একটি ফুটবল ক্লাবের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেন ফুটবলার, ম্যানেজার কিংবা ক্লাবের মালিক৷ তবে সবকিছুর যেন ঊর্ধ্বে থাকেন ‘স্পোর্টিং ডিরেক্টর’ নামক ভদ্রলোক৷ তার নিখুঁত পরিকল্পনা আর হিসেব-নিকেশে ক্লাবের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। তাই তাকে ক্লাবের ‘মগজ’ বললেও সম্ভবত বাড়াবাড়ি হবে না।
ফুটবল ট্রান্সফার সংক্রান্ত সংবাদের মূল কেন্দ্রে সবসময়ই থাকেন ফুটবলাররা। ম্যানেজার, এজেন্ট কিংবা কখনো ক্লাবের মালিকরাও ট্রান্সফারের উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলেন। তবে সম্প্রতি ফুটবলে একটি নতুন পদ আরও বেশি নজর কেড়েছে প্রতিটি ট্রান্সফার উইন্ডোতে। সেটি হলো স্পোর্টিং ডিরেক্টর। মূলত একটি ক্লাবের ফুটবল পরিচালনায় ধারাবাহিকতা, টেকসই কৌশল এবং স্থায়িত্ব নিশ্চিত করাই স্পোর্টিং ডিরেক্টরের কাজ। তিনি কোচিং স্টাফ এবং ক্লাবের পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করেন। জুভেন্টাসের বর্তমান জেনারেল ম্যানেজার এবং লিভারপুল, ফেনারবাচ, সেন্ট-এতিয়েন ও টটেনহ্যাম হটস্পারের সাবেক স্পোর্টিং ডিরেক্টর ড্যামিয়েন কোমোলি বলেন,‘স্পোর্টিং ডিরেক্টর হলেন ক্লাবের সংস্কৃতির রক্ষক।’
যদিও চলতি শতকের শুরুতে প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোতে এই ধরনের ডিরেক্টর ছিলেন একেবারেই বিরল, কিন্তু বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় ক্লাবগুলোতে স্বাভাবিক পদে পরিণত হয়েছে এই স্পোর্টিং ডিরেক্টর। ইউরোপের প্রধান লিগগুলো তথা ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, স্পেন এবং নেদারল্যান্ডসের প্রতিটি ক্লাবেই অন্তত একজন করে স্পোর্টিং ডিরেক্টর রয়েছেন। ফ্রান্সের লিগ ওয়ান-এ ১৮টির মধ্যে ১৫টি ক্লাবে এই পদ রয়েছে। প্রিমিয়ার লিগে ২০১৬-১৭ মৌসুমে যেখানে মাত্র ১৩টি ক্লাবে এই পদ ছিল, ২০২৩-২৪ মৌসুমে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯টি ক্লাবে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ ক্লাবে এই দায়িত্ব দুটি পৃথক পদে ভাগ করা হয়।
আরও পড়ুন:
» কোটি কোটি টাকা আয় করেও যে কারণে দেউলিয়া হচ্ছেন ফুটবলাররা
» আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল– কার ঝুলিতে কত শিরোপা?
স্পোর্টিং ডিরেক্টরের কাজ কি?
ক্লাব ফুটবলে বর্তমানে স্পোর্টিং ডিরেক্টর পদের গুরুত্ব বাড়লেও তাদের কাজ ও দায়িত্বপালনের ধরণ ক্লাবভেদে ভিন্ন। ক্লাবের কোচ বা ম্যানেজারের ভূমিকা যেখানে স্পষ্ট, সেখানে স্পোর্টিং ডিরেক্টরের দায়িত্ব নির্দিষ্ট নয়। এক্ষেত্রে ক্লাবের বা লিগের মান অনুযায়ী এই ভূমিকার চারপাশের কাঠামো একেক রকম।
জার্মানিতে যেমন স্পোর্টিং ডিরেক্টরের সঙ্গে থাকেন ‘কাডারপ্ল্যানার’ (রেক্রুটমেন্ট প্রধান), টেকনিক্যাল ডিরেক্টর, এমনকি শুধু ক্রীড়া বিষয়ক একজন নির্বাহীও। তবে এতো পদের মাঝে স্পোর্টিং ডিরেক্টরের কাজ আলাদা করা কঠিন। এ নিয়ে সাবেক হামবুর্গ ও বায়ার লেভারকুজেনের স্পোর্টিং ডিরেক্টর জোনাস বোল্ডট বলেন,‘এতগুলো পদ থাকলে কখনো কখনো বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে কে আসলে কতটা ক্ষমতা রাখে বা কার দায়িত্বটা ঠিক কী।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফুটবলের গঠনগত পরিবর্তনের কারণে এই ভূমিকার পরিধি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। ড্যামিয়েন কোমোলি বলেন, “ক্লাবের কাঠামো পরিবর্তিত হচ্ছে। দশ বছর আগে যদি আমি বলতাম, এই ভূমিকাগুলো একে অন্যের কাজ কেড়ে নিচ্ছে — এখন বলি, তারা একে অপরকে পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে।”
প্রিমিয়ার লিগের ব্রেন্টফোর্ড ক্লাবের ক্ষেত্রে দেখা যায় ফিল জাইলস স্কোয়াড ম্যানেজমেন্ট ও চুক্তির বিষয়ে কাজ করেন। অন্যদিকে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর লি ডাইকস দায়িত্ব নেন স্কাউটিংয়ের। তাই ক্লাবের সংস্কৃতি ও কাঠামো বিবেচনায় একেক ক্লাবে স্পোর্টিং ডিরেক্টরের কাজ আলাদা হতে পারে।
আরও পড়ুন:
» কেন এত ফুটবলাররা ১০ নম্বর জার্সি পরতে চায়?
» সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপে সবচেয়ে বেশি শিরোপা কার?
কীভাবে একজন স্পোর্টিং ডিরেক্টর হতে পারেন?
স্পোর্টিং ডিরেক্টরদের পূর্ব অভিজ্ঞতা বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। স্পোর্টিং ডিরেক্টর পদে আসার আগে কেউ কাজ করেন ডেটা নিয়ে, কেউ ফুটবল একাডেমিতে আবার কেউ সাংবাদিকতা থেকেই এই পদে নিয়োগ পেয়েছেন।
ইংলিশ ক্লাব ব্রেন্টফোর্ডের ফিল জাইলস ছিলেন পরিসংখ্যানে পিএইচডি ডিগ্রিধারী। তিনি স্মার্টঅডস নামক একটি ডেটা কোম্পানিতে কাজ করেছেন। অন্যদিকে, লি ডাইকস ছিলেন কার্লাইল ইউনাইটেডের সহকারী কোচ এবং পরে বুরি ক্লাবের স্পোর্টিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন।
বিখ্যাত ডেটা প্রতিষ্ঠান ‘Traits’ চারটি প্রধান ‘আর্কিটাইপ’ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, স্পোর্টিং ডিরেক্টররা মূলত চারটি ভিন্ন পেশা থেকে উঠে আসেন। এগুলো হলো– কোচ বা ম্যানেজার, রিক্রুটার(স্কাউটিং এবং ট্রান্সফার পরিকল্পনা নির্ধারণ করেন এবং ডেটা বিশ্লেষণের দক্ষতা রাখেন), সাবেক ফুটবলার এবং এক্সিকিউটিভ(যিনি ফুটবলারদের চুক্তি, কোচিং স্টাফ নিয়োগ, অর্থনৈতিক দিক সামলান)
আবার অনেকে ক্লাবের এক পদ থেকে অন্য পদে উঠে আসেন স্পোর্টিং ডিরেক্টররা। নরউইচ সিটির স্পোর্টিং ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে বেন ক্ন্যাপার আর্সেনালের ‘লোন অ্যান্ড পাথওয়ে ম্যানেজার’ হিসেবে কাজ করেছিলেন।
সাধারণত ফুটবল সংশ্লিষ্টরাই স্পোর্টিং ডিরেক্টরের চেয়ারে বসে থাকেন৷ তবে Traits-এর গবেষণায় দেখা যায়, ১৭% স্পোর্টিং ডিরেক্টর ফুটবলের বাইরে বা নন-টেকনিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন। এর মধ্যে স্কট মুন (টটেনহ্যামের প্রাক্তন প্রধান ফুটবল অফিসার) আসেন রাগবি ও অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল লিগের বাণিজ্যিক পরিচালনা পর্ষদ থেকে।
অ্যাস্টন ভিলার ডিরেক্টর অফ ফুটবল অপারেশনস ড্যামিয়ান ভিদাগানি ছিলেন একসময় সাংবাদিক। পরবর্তীতে তিনি কাজ করেন মিডিয়া সংস্থা DV7-এ। তিনিও আসেন ফুটবলের বাইরে থেকে।
আরও পড়ুন:
» টেস্টে ‘স্টপ ক্লক’, ক্রিকেটে আরও যত নিয়ম আনল আইসিসি
» যেভাবে অলিম্পিকে হবে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট
স্পোর্টিং ডিরেক্টরের সফলতা কীভাবে মাপা হয়?
স্পোর্টিং ডিরেক্টরদের সফলতা ক্লাবের মূলনীতির ওপর নির্ভর করে। ট্রফি জেতাই কোনো কোনো ক্লাবে স্পোর্টিং ডিরেক্টরদের সফলতার মানদণ্ড বলে ধরে নেওয়া হয়, আবার কোনো ক্লাবে কতটা নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা, প্লেয়ার সাইনিং ও ক্লাবের সার্বিক ব্যবস্থাপনা তদারকি করে থাকেন, তা বিবেচনায় রাখা হয়।
বুন্দেসলিগার ক্লাব হামবুর্গের সাবেক স্পোর্টিং ডিরেক্টর জোনাস বোল্ডট বলেন,“আমার কাজ ছিল ক্লাবকে স্থিতিশীল রাখা, নতুন পরিচয় গড়ে তোলা, তরুণ খেলোয়াড়দের গড়ে তোলা এবং কোচদের সহায়তা করা।
হামবুর্গ গত ১২ বছরের মধ্যে প্রথমবার এক অসাধারণ বছর কাটিয়েছে। ২০২৪ সালে ক্লাবটি পুনরায় বুন্দেসলিগায় উন্নীত হয়েছে। এছাড়া স্টেডিয়াম নির্মাণ-সংক্রান্ত ঋণও পরিশোধ করেছে ক্লাবটি। এ নিয়ে বোল্ডট বলেন,“তাৎক্ষণিক প্রমোশন পেলে হয়তো বিপদে পড়তাম, কারণ ক্লাব তখনো অস্থিতিশীল ছিল। তবে এখন আমাদের ভিত্তি অনেক শক্তিশালী, এটাই আমার সফলতা।”
সাউদাম্পটনের স্পোর্টিং ডিরেক্টর জোহানেস স্পোর্স বলেন,“আমার কাজ হলো ক্লাবের সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়ানো। শুধুমাত্র খেলোয়াড় সই করানোই নয়, আমরা চেষ্টা করি ক্লাবের সংস্কৃতি গড়ে তোলা।”
ক্রিফোস্পোর্টস/২৪জুলাই২৫/বিটি
