
প্রতিপক্ষের বল কেড়ে নেওয়া থেকে শুরু করে পাসিং, মাঠজুড়ে ফুল-ব্যাকদের আধিপত্য, আর ফরোয়ার্ডদের ফাইনাল থার্ডে কার্যকারিতা — সবমিলিয়ে এককথায় দৃষ্টিনন্দন ফুটবল। এতক্ষণে নিশ্চয় দলটার নাম আঁচ করতে পেরেছেন, হ্যাঁ পিএসজি। চলতি মৌসুমজুড়ে প্রতিপক্ষের কাছে যেন এক আতঙ্কের নাম ফরাসি ক্লাবটি। পিএসজির বিপক্ষে খেলা না হলেই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে দলগুলে। লিগ ওয়ান থেকে শুরু করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং সবশেষ ক্লাব বিশ্বকাপেও বল পায়ে দাপট দেখিয়ে যাচ্ছে লুইস এনরিকের ‘মেশিন’ খ্যাত পিএসজি৷ তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগছে, পিএসজি কি বর্তমানে ফুটবলের সেরা ক্লাব?
নিউ জার্সির ইস্ট রাদারফোর্ডের প্রচণ্ড গরমে গত বুধবারের(৬ জুলাই) সেমিফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদ ও তাদের অসংখ্য সমর্থকদের ম্যাচের মাত্র ৯ মিনিটে ২ গোল দিয়ে চমকে দেয় পিএসজি। ২৪তম মিনিটে ফের রিয়ালের জালে বল জড়ায় তারা৷ এবার আশরাফ হাকিমির ডান দিক দিয়ে দুর্দান্ত দৌড় এবং তার বাড়ানো বল থেকে ফাবিয়ান রুইজের নিখুঁত ফিনিশিংয়ে ৩ গোলে এগিয়ে যায় লুইস এনরিকের শিষ্যরা। এতেই ম্যাচের ফলাফল আর ফাইনালে চেলসির প্রতিপক্ষ কে হতে যাচ্ছে, তা অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যায়।
পিএসজির খেলার ধাঁচ দেখে অনেকেরই মনে হচ্ছিল যেন তখনই ফিফা পিএসজিকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে দিলেই পারত, যদিও ম্যাচের তখনো বাকি ছিল এক ঘণ্টা। চলতি বছরের শুরু থেকে বল পায়ে পিএসজি এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে, যা বিস্মিত করেছে স্বয়ং কোচ লুইস এনরিকেকেও। ক্লাবের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে তারা এবার ক্লাব বিশ্বকাপ জয়ের পথেও দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে। ফাবিয়ান রুইজ তাদের ৪-০ ব্যবধানের জয়কে বলেছেন “পারফেক্ট” — আর কোচ এনরিকে এই জয়কে বলেছেন “সুন্দর”।
আরও পড়ুন:
» দিয়োগো জোটার স্মরণে যেভাবে এক হলো গোটা ফুটবল দুনিয়া
» ৪৪ বছরেও গোল পোস্টের অতন্দ্র প্রহরী, কে এই ব্রাজিলিয়ান?
পিএসজি এক সময় ছিল তারকায় ভরপুর৷ আক্রমণভাগে ছিল সময়ের সেরা তিন ফুটবলার মেসি, নেইমার আর এমবাপ্পে। কিন্তু এতেও বড় কোনো শিরোপা জেতা হয়নি দলটির। এত বড় বড় তারকার ইগো ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক আচরণ সামাল দিতেই ব্যর্থ হতেন নামকরা কোচেরা। এর ঠিক উল্টো উদাহরণ তৈরি করেছেন লুইস এনরিকে। গত গ্রীষ্মে পিএসজি তাদের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা এমবাপ্পেকে রিয়ালের কাছে হারালেও তার অনুপস্থিতি মোটেও টের পায়নি পিএসজি। বরং এমবাপ্পে ছাড়াই দলটি হয়েছে আরও শানিত, আরও ভারসাম্যপূর্ণ। এক কথায়, মাঠে তাদের মাঝে দেখা যায় এক অসাধারণ কেমিস্ট্রি। দায়িত্ব নেওয়ার পর লুইস এনরিকের মূল কাজই ছিল পিএসজির সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন আনা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে সেটাই প্রমাণ করলেন তিনি৷ এবার লক্ষ্য ক্লাব বিশ্বকাপও।
রিয়াল মাদ্রিদের এই সময়ের যাত্রাপথ অবশ্য খুবই সাধাসিধে। অথচ ঠিক এক বছর আগেই তারা ১৫তম বারের মতো ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। কিন্তু এরপরই যেন ভীষণভাবে গড়বড় শুরু হয়েছে ক্লাবটির৷ কোচ শাবি আলোনসো চাইছেন, যেন এই টুর্নামেন্টকে গত মৌসুমের সমাপ্তি হিসেবে দেখা হয় — তবে বাস্তবতা হলো, ৬৮ ম্যাচের ১৫টিতে হেরেছে রিয়াল, যেখানে গত মৌসুমে হার ছিল মাত্র দুটি। কোচ আলোনসো বায়ার লেভারকুজেনকে যেভাবে সাফল্যের শিখরে তুলেছেন, মাদ্রিদকেও একই উচ্চতায় নিতেই এখানে এসেছেন। কিন্তু বেলিংহ্যাম, এমবাপ্পে, ভিনিসিয়ুস জুনিয়রদের মতো প্রতিভাদের কাজে লাগিয়ে এবং তাদের সেরাটা বের করে এনে দলগত ভারসাম্য গড়াই এখন আলোনসোর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।

ক্লাব বিশ্বকাপে আরেকটি বড় শিরোপা জয়ের হাতছানি পিএসজির সামনে। ছবি- সংগৃহীত
এদিক থেকে অনেকটাই এগিয়ে পিএসজি। দুই উইঙ্গার দেজিরে দুয়ে ও খাভিচা কাভারাটস্খেলিয়া কিংবা উসমান দেম্বেলের সঙ্গে দলটির মিডফিল্ড ও দুই ফুলব্যাকের যে বোঝাপড়া, সেটাই গড়ে দেয় ম্যাচের পার্থক্য। মাদ্রিদকে বিধ্বস্ত করার ম্যাচের পর “ম্যান অব দ্য ম্যাচ” হওয়া ফাবিয়ান রুইজ বলেছেন,“এটা দলীয় প্রচেষ্টার ফল। আমাদের অনেক ভালো খেলোয়াড় আছে, কিন্তু দলীয় প্রচেষ্টা ছাড়া আমরা কিছুই না।”
আরও পড়ুন:
» অলিম্পিক-বিশ্বকাপ খেলতে বাংলাদেশকে কী করতে হবে
» দুর্গম পাহাড় থেকে দেশের গর্ব, ঋতুপর্ণার ফুটবল জার্নি যেমন ছিল
দলগত প্রচেষ্টাই একের পর এক সাফল্য এনে দিয়েছে এই ফরাসি ক্লাবকে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ম্যানচেস্টার সিটিকে হারানো, লিভারপুল, অ্যাস্টন ভিলা ও আর্সেনালের মতো ইংলিশ ফুটবলের নামকরা ক্লাবকে বিদায় করার পর সব হিসেব-নিকেশ পাল্টে দিয়ে ইন্টার মিলাকে ফাইনালে ৫-০ ব্যবধানে উড়িয়ে দেয় পিএসজি। যা কিনা ইতিহাসের সবচেয়ে একপেশে ফাইনাল বলেও মনে করা হয়। এমন অপ্রতিরোধ্য পিএসজিকে আগে কখনোই দেখা যায়নি৷ তাই পিএসজিকে বর্তমানে ফুটবলের সেরা ক্লাবের তকমা দিচ্ছেন অনেকেই।
যদিও ক্লাব বিশ্বকাপের মতো নকআউট টুর্নামেন্ট কখনোই ফুটবলের প্রকৃত অবস্থা পরিমাপের জন্য ভালো কোনো মানদণ্ড নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ক্লাব বিশ্বকাপের ক্ষেত্রে বলা হয়, এখানে “বিশ্বের ৩২টি সেরা দল” খেলে থাকে৷ তবে দাবিটি নিতান্তই যে ভুল তার বড় কারণ বার্সেলোনা, লিভারপুল এবং নাপোলি — যারা কিনা স্পেন, ইংল্যান্ড ও ইতালির চ্যাম্পিয়ন, তাদের অংশগ্রহণ না থাকা। বরং ওয়াইদাদ এসি, এস তিউনিস, রেড বুল সালজবুর্গ বা ইন্টার মায়ামির মতো দল অংশ নিয়েছে এই টুর্নামেন্টে, তবে তারা নিশ্চিতভাবেই বিশ্বসেরা ৩২ দলের মধ্যে পড়ে না। তাই কখনো কখনো বিশ্বসেরা দলের তকমা নিয়ে বিতর্ক হয়। কিন্তু কিছু সময় আসে যখন বিশ্বসেরা ক্লাব কোনটি, তা একেবারেই স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমনটি হয়েছিল গার্দিওলার বার্সেলোনা যুগে এবং সাম্প্রতিক সময়ে গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি। এখন লুইস এনরিকের অধীনে পিএসজিরও যেন সেরা হওয়ার সময়টা এসেছে।
ক্লাব বিশ্বকাপে ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে ৬২ ম্যাচ, বাকি মাত্র একটি। আগামী ১৩ জুলাই চেলসি ও পিএসজির মধ্যকার ফাইনাল দিয়ে জানা যাবে চ্যাম্পিয়নদের নাম। তবে কে হবে চ্যাম্পিয়ন তা নিয়ে দ্বিধা থাকলেও বর্তমানে বিশ্বের সেরা দল নির্ধারণের ক্ষেত্রে কারোই কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয়।
ক্রিফোস্পোর্টস/১২জুলাই২৫/টিএইচ/বিটি
