
আমার মনে হয় না, এর চেয়ে ভালো শুরু করা যেত— কথাগুলো চেলসির নতুন বিস্ময় জোয়াও পেদ্রোর। ‘বিস্ময়’ শব্দে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে, তবে ক্লাব বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে নজরকাড়া দুটি গোল করে ‘বিস্ময়’ শব্দটি নিজের করে নিয়েছেন চেলসির এই ২৩ বছর বয়সী নতুন ফরোয়ার্ড।
ইংলিশ ক্লাব ব্রাইটন থেকে সদ্য যোগ দিয়েছেন চেলসিতে। নতুন ক্লাবের হয়ে প্রথমবার শুরুর একাদশে নেমেই বল পায়ে জাদু আর বিস্ময়ের মেলবন্ধন উপহার দিলেন পেদ্রো। দলটির জার্সিতে প্রথম গোলের পরেই সতীর্থ পেদ্রো নেটোর সেই হতবাক হওয়ার ভঙ্গি আপনাকে মনে করিয়ে দিতে পারে, কেন জোয়াও পেদ্রো এখন চেলসির নতুন বিস্ময়।
দু-দুটি গোল, তাতেই চেলসি পা রাখল ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনালে। এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছে চেলসি। এর আগে ২০১২ ও ২০২১ সালে ফাইনাল খেলেছে ইংলিশ ক্লাবটি। ২০১২ সালে রানার্সআপ হলেও ২০২১ সালে শিরোপা জিতেছিল তারা। চেলসির জয়ের দিনে গোল দুটিই করেছেন জোয়াও পেদ্রো। শুধু গোল বললে অবশ্য ভুলই হবে, বরং ‘চোখের আরাম’ বলাই যুক্তিযুক্ত।
আরও পড়ুন :
» দুর্গম পাহাড় থেকে দেশের গর্ব, ঋতুপর্ণার ফুটবল জার্নি যেমন ছিল
» দিয়োগো জোটার স্মরণে যেভাবে এক হলো গোটা ফুটবল দুনিয়া
» বিপিএলে যুক্ত হচ্ছে নতুন ভেন্যু, জেনে নিন কোনটি
ম্যাচের বয়স তখন ১৮ মিনিট। বাঁ প্রান্ত দিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে গিয়ে পেদ্রো নেটো বল বাড়িয়ে দেন ফ্লুমিনেন্সের বক্সে। একজন ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে বল চলে আসে বক্সের ঠিক বাইরে দাঁড়ানো পেদ্রোর কাছে। মুহূর্তেই বল দারুণভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বক্সের বাইরে থেকেই গতিময় এক কার্ল শটে বল পাঠান জালে। গোলকিপার ফাবিও ঝাঁপিয়ে পড়লেও নাগাল পাননি বলের। গোলটি দেখে মাঠেই বিস্ময়ের ভঙ্গিতে মাথায় হাত দিয়ে ফেলেন নেটো।
৫৬তম মিনিটে ফের দেখা গেল পেদ্রো ম্যাজিক। এবারের গোলটি আরও দুর্দান্ত। মাঝমাঠ থেকে অধিনায়ক এনজো ফের্নান্দেস বল বাড়ান বাঁ প্রান্তে থাকা পেদ্রোর দিকে। দ্রুতগতিতে বল ধরে বক্সে ঢুকে যান পেদ্রো। একজনকে কাটিয়ে দুইজনের মাঝ দিয়ে আচমকা শট নেন তিনি। জোরালো শটে বল ক্রসবারে লেগে ঢুকে যায় জালে- এবারও অসহায় ছিলেন গোলকিপার।
গোলের পর সবাই যখন বিস্ময়ে হতবাক, তখন পেদ্রো ছিলেন পুরোপুরি নির্লিপ্ত। ক্যারিয়ারের অন্যতম বড় মঞ্চে এমন গোলের পর যেখানে উদযাপন হওয়ার কথা বাঁধনহারা, সেখানে চেলসির নতুন তারকা গোল করে ভঙ্গি করলেন ক্ষমা চাওয়ার। মাঠের বাইরেও তার কণ্ঠে ঝরেছে দুঃখপ্রকাশের সুর। মূলত পেদ্রোর কাছে ম্যাচটি ছিল অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার। চেলসি একদিকে ভবিষ্যৎ, আর ফ্লুমিনেন্স ছিল অতীত। তাই ছোটবেলার ক্লাব ফ্লুমিনেন্সের জালে গোল দিয়ে উদযাপন থেকে বিরত ছিলেন তিনি।
পেদ্রোর আজকের ‘পেদ্রো’ হয়ে উঠার মঞ্চও গড়ে দিয়েছিল ফ্লুমিনেন্স। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ফ্লুমিনেন্স থেকে ওয়াটফোর্ডে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে ইংলিশ ফুটবলে পা রাখেন পেদ্রো। ম্যাচ শেষে তাই ক্লাবের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলেননি তিনি। পেদ্রো বলেন, “যখন আমি তরুণ ছিলাম, আমার কিছুই ছিল না। ফ্লুমিনেন্স আমাকে সবকিছু দিয়েছে। গোটা বিশ্বের সামনে আমাকে তুলে ধরেছে তারা। আজ আমি এখানে আসতে পেরেছি, কারণ তারা আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছে।”
পেদ্রোর জন্ম ব্রাজিলের সাও পাওলোতে। বাবা জোসে জোয়াও দে জেসুসও ছিলেন ফুটবলার, খেলতেন বিখ্যাত বোটাফোগো ক্লাবে। ব্রাজিলের ফুটবলে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘চিকাও’ নামে। মাত্র ২৩ বছর বয়সেই খুনে সহায়তার অভিযোগে ১৬ বছরের জেল হয় তার। চিকাও প্রথমবার জেলে যাওয়ার সময়ই স্ত্রীর সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ছেলে পেদ্রোকে নিয়ে তার মা পাড়ি জমান রিও ডি জেনেইরোয়।
সেখানে ১০ বছর বয়সে ফ্লুমিনেন্সের একাডেমিতে যোগ দেন পেদ্রো। এরপর ফ্লুমিনেন্সেই তাকে গড়ে তোলেন ফুটবলার হিসেবে। বয়স ১৮ হওয়ার আগেই ফ্লুমিনেন্সের হয়ে তার অভিষেক হয় পেশাদার ফুটবলে। ফ্লুমিনেন্সের জার্সিতে মাত্র এক মৌসুম খেলেই ৩৭ ম্যাচে করেন ১০ গোল।
ফ্লুমিনেন্স থাকাকালীন প্রতিভাবান এই ফুটবলারের সঙ্গে চুক্তি করে ইংল্যান্ডের ক্লাব ওয়াটফোর্ড। বয়স ১৮ পূর্ণ হওয়ার পর ইংলিশ ক্লাবটিতে পা রাখেন তিনি। সেখানে তিন মৌসুম খেললেও নিজেকে ঠিকঠাক মেলে ধরতে পারেননি পেদ্রো- ১০৯ ম্যাচে তার পা থেকে আসে ২৪ গোল। তবে ২০২৩ সালে তাকে দলে ভেড়ায় আরেক ইংলিশ ক্লাব ব্রাইটন অ্যান্ড হোভ। সেখানে তার সময় কাটে ভালোমন্দ মিলিয়ে। দারুণ কিছু ঝলক যেমন দেখান তিনি, তেমনি ছিল অধারাবাহিকতা ও শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনাও। সব মিলিয়ে ৭০ ম্যাচে গোল করেছেন ৩০টি।
গত ২ জুলাই ৫৫ মিলিয়ন ইউরোতে তাকে আট বছরের চুক্তিতে দলে ভেড়ায় চেলসি। দুদিন পরই নতুন ক্লাবের হয়ে তার অভিষেক হয় ক্লাব বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনালে। বদলি নেমে সেদিন আরেক ব্রাজিলিয়ান ক্লাব পালমেইরাসের বিপক্ষে অল্পের জন্য গোলের দেখা পাননি পেদ্রো। সেমিফাইনালে শুরুর একাদশে জায়গা পেয়ে সেই আক্ষেপ আর রাখলেন না, গোল করে চেলসির প্রত্যাশাও মেটালেন এই তারকা।
মূলত তার দিকে চেলসির নজর পড়ার মূল কারণ ছিল দুটি- একদিকে পেদ্রো যেমন প্রিমিয়ার লিগে ইতোমধ্যে সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন, অন্যদিকে একাধিক পজিশনে খেলতে পারেন তিনি। দলের প্রয়োজনে কখনো সেন্টার ফরোয়ার্ড, আবার কখনো খেলতে পারেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবেও।
ক্রিফোস্পোর্টস/১০জুলাই২৫/টিএইচ/এসএ
