
বল পায়ে লিওনেল মেসির অসাধারণ কোনো মুহূর্তে মুগ্ধ হয়ে এতদিন উল্লাসে মেতে উঠত বাংলাদেশের সমর্থকরা। তার পায়ের জাদুতে আর্জেন্টিনার শিরোপাজয়ের উৎসবে তাল মেলাত বাংলাদেশও। ঋতুপর্ণা চাকমা যেন মেয়েদের ফুটবলের মেসি। দুর্গম পাহাড় ডিঙিয়ে আসা ঋতুর পায়ের জাদুতে এখন এশিয়া কাপে বাংলাদেশ। ইতিহাসের পাতায় নতুন করে লেখা হয়েছে বাংলাদেশ ও ঋতুপর্ণা চাকমার নাম।
বাংলাদেশের চেয়ে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ৭৩ ধাপ এগিয়ে থাকা মিয়ানমারকে ২-১ গোলে হারিয়ে এএফসি এশিয়া কাপের চূড়ান্ত পর্ব নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। দুটি গোলই এসেছে ঋতুপর্ণার পা থেকে। গোল তো নয়, যেন চোখের আরাম। প্রথম গোলটি করতে ঋতুপর্ণা যা দেখালেন, তা রীতিমতো বিস্ময়ের। তার নেওয়া ফ্রি–কিক মিয়ানমারের রক্ষণে মেয়েদের গড়ে তোলা দেয়ালে লাগার পর ফের নিজেই বলটা পেয়ে নিখুঁত আর দুর্দান্ত গতির শটে পাঠিয়ে দিলেন জালে। বাঁ দিকে ঝাঁপ দিয়েও বলের হদিস পাননি মিয়ানমারের গোলকিপার।
দ্বিতীয় গোলটি ছিল আরও চোখধাঁধানো। কোনো ক্রস ছাড়াই মাঠের বাঁ প্রান্ত থেকে বক্সের পাশ ঘেঁষে দুর্দান্ত এক শটে গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে বল জড়িয়ে দেন জালে। সাধারণত এমন মুহূর্তে উইঙ্গাররা বল ক্রস দিয়ে থাকেন, তবে ঋতুপর্ণার ক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি, বরং নিজেই দুর্দান্ত এক গোল করে স্তব্ধ করে দেন প্রতিপক্ষের দর্শকদের। ম্যাচজুড়েই বাঁ প্রান্তে খেলা ঋতুর গতি, বলের নিয়ন্ত্রণ আর শুটিং মুগ্ধ করেছে গোটা স্টেডিয়ামকে।
আরও পড়ুন :
» যার হাতে উঠছে ক্লাব বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুট
» অলিম্পিক-বিশ্বকাপ খেলতে বাংলাদেশকে কী করতে হবে
» শ্রীলঙ্কার মাটিতে ইতিহাস গড়ার হাতছানি বাংলাদেশের সামনে
পুরুষ ফুটবলের মতো বাংলাদেশের নারী ফুটবলও এখন এক নতুন সূর্যোদয়ের মুখোমুখি। সেই সূর্যোদয়ের সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার নাম ঋতুপর্ণা চাকমা। তাই তাকে নিয়েই প্রশংসার জোয়ার বইছে দেশের ফুটবলে। প্রশংসার জোয়ারে যোগ দিয়েছেন বাফুফের নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরনও। ঋতুপর্ণাকে তিনি তুলনা করেছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঋতুপর্ণা আমাদের মেয়েদের মেসি। ওর বল কন্ট্রোল, গতি আর ফিনিশিং—সবই অসাধারণ। বল টেনে নিয়ে যাওয়ার স্টাইলে মেসির ছায়া দেখা যায়।’
মেয়েদের ফুটবলে ‘মেসি’ হয়ে ওঠা ঋতুপর্ণার শুরুটা মোটেও সুখকর ছিল না। বরং রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ি গ্রাম মগাছড়ি থেকে এক কঠিন সংগ্রাম জয় করে দেশের ফুটবলে পা রেখেছেন ঋতু। তার বাবা বরজ বাঁশি চাকমা ছিলেন কৃষক। তবে তার তেমন জমিজমা ছিল না। ফসল যা পেতেন, তা দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হতো। কিন্তু বছর দশেক আগে ক্যানসারে বরজ বাঁশি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ঋতু ও তার পরিবারকে ফেলে যান অথৈ সাগরে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে পাঁচ সন্তানকে নিয়ে দুঃসহ জীবন কাটাতে থাকেন ঋতুর মা বোজপুতি চাকমা। বহু কষ্টে কাটতে থাকে একেকটি দিন। শেষ পর্যন্ত পরিবারের আশার আলো হয়ে দেখা দেন ঋতুপর্ণা চাকমা।
গ্রামের মাঠে ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে পায়ের নখ উঠে গিয়েছিল ঋতুর। অনেকটা জোর করেই তাকে দিয়ে ফুটবল খেলাতেন শিক্ষকেরা। বীরসেন চাকমা নামের এক স্কুলশিক্ষকের সহায়তায় ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকেন ঋতু। আত্মীয়তার সূত্রে বীরসেন আর ঋতুপর্ণা কাকা-ভাতিজি। কাছাকাছি বাড়ি। ফলে তিনি সবসময় চাইতেন, ছোট্ট মেয়েটি ফুটবল খেলুক। ছায়ার মতো ভাতিজিকে আগলে রাখতেন বীরসেন, ফুটবলের জন্য যাবতীয় আর্থিক সহায়তাও দিতেন তিনি। ২০১৬ সালে সাভারের বিকেএসপিতে ভর্তি হন ঋতুপর্ণা। ভীষণ সম্ভাবনাময় এই ফুটবলার প্রতিটি ট্রায়ালেই হন প্রথম। বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়া এবং আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ তখন ৪০-৫০ হাজার টাকা দরকার ছিল। কিন্তু পরিবারের কাছে অত টাকা ছিল না। এবারও আশার আলো হয়ে এগিয়ে আসেন সেই বীরসেন। ঋতুর জন্য টাকা সংগ্রহ করেন।
পরিবার কিংবা বীরসেনকে হতাশ হতে হয়নি। ওই বছরেই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ক্যাম্পে সুযোগ পান ঋতুপর্ণা। মাত্র ৮-৯ বছরের মধ্যে সাফল্যের শীর্ষে উঠে যান তিনি। একে একে ২০২২ ও ২০২৪ সাফ নারী চ্যাম্পিয়ন দলের গর্বিত সদস্য হন ঋতুপর্ণা চাকমা। ২০২৪ সাফ টুর্নামেন্টের সেরা ফুটবলারও হয়েছিলেন তিনি। তবে এতসব সাফল্য আর আনন্দের মাঝে ঋতুর পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে। ২০২২ সালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায় ঋতুর ছোট ভাই পার্বণ চাকমা। পার্বণের শোক কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে পরিবারের।
সবশেষ এশিয়ান কাপ কোয়ালিফায়ারে বাহরাইনের বিপক্ষে বাংলাদেশের ৭-০ গোলের জয়ে ঋতু করেছিলেন ১টি গোল। সেই গোলের পর আকাশের দিকে তাকিয়ে ছোট ভাইকে যেন স্মরণ করেন ঋতু। ভাইকে অকালে হারানোর শোক তাকে আরও শক্তি দিয়েছে, দিয়েছে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণাও। পারিবারিক সংগ্রাম, দারিদ্র্যের বাধা টপকে আর একজন বীরসেনের সহায়তায় আজকের নারী ফুটবলের ‘মেসি’ হয়ে উঠেছেন ঋতুপর্ণা চাকমা। একই সঙ্গে হয়ে উঠেছেন রাঙামাটির মতো অন্যান্য প্রত্যন্ত এলাকার অসংখ্য সম্ভাবনাময় ক্ষুদে ফুটবলারদের প্রেরণার গল্পের চরিত্র।
ক্রিফোস্পোর্টস/৮জুলাই২৫/টিএইচ/এসএ
