
“পর্তুগাল থেকে আসা এক ছেলে, লুই ফিগোর চেয়েও ভালো খেলে, তোমরা কি কেউ তার নাম জানো গো, সে যে অ্যানফিল্ডের প্রিয় দিয়োগো..” দিয়োগো জোটাকে নিয়ে লিভারপুল সমর্থকরা এভাবেই সঙ্গীতের তালে গ্যালারি থেকে গেয়ে উঠত। অথচ এই সঙ্গীত এখন শুধুই স্মৃতি।
জীবন-গল্পের স্ক্রিপ্ট এভাবেও শেষ হয়? সপ্তাহ দুয়েক আগেই শুরু হয়েছিল যে জীবনের নতুন অধ্যায়, বিয়ে করেছিলেন ভালোবাসার মানুষকে, স্বপ্নভরা চোখে সেরা হওয়ার তাড়না- সবকিছু ফিকে হয়ে গেল এক নিমেষে। জীবন যে কতটা ছোট আর অপ্রত্যাশিত, দিয়োগো মনে করিয়ে দিলেন আরেকবার। অথচ মাত্র তিন মাসের মধ্যে প্রিমিয়ার লিগ আর নেশন্স লিগের শিরোপা উঁচিয়ে ধরার তরতাজা দৃশ্য, আর ওই নম্বর টুয়েন্টি জার্সি এখনো দর্শকদের স্মৃতিতে রয়ে গেছে।
দিয়োগো জোটার অকাল প্রয়াণ কাঁদিয়েছে গোটা ফুটবল দুনিয়াকে। আবার জোটাই এক করেছে ফুটবল বিশ্বকে। মেসি, রোনালদো, নেইমার কিংবা লাল-সবুজের জামাল ভূঁইয়া- সবার স্মরণেই ছিল শুধুই একটি নাম: দিয়োগো জোটা। জোটার সতীর্থদের নাড়া দিয়েছে আরও বেশি। ক্লাব বিশ্বকাপ খেলতে নেমে আল-হিলালে খেলা পর্তুগালের দুই তারকা রুবেন নেভেস আর জোয়াও ক্যান্সেলো ছলছল চোখে স্মরণ করেছেন প্রিয় বন্ধু দিয়োগোকে। ম্যাচটা কখন শেষ হবে, সেই অপেক্ষায় যেন ছিলেন রুবেন নেভেস। ম্যাচ শেষ করে মাত্র ১১ ঘণ্টার মধ্যে সুদূর আমেরিকা থেকে জোটার শেষকৃত্যে অংশ নিতে উড়াল দেন পর্তুগালে।
আরও পড়ুন
» অলিম্পিক-বিশ্বকাপ খেলতে বাংলাদেশকে কী করতে হবে
» দুর্গম পাহাড় থেকে দেশের গর্ব, ঋতুপর্ণার ফুটবল জার্নি যেমন ছিল
» বাংলাদেশের ম্যাচসহ টিভিতে আজকের খেলা (৮ জুলাই ২৫)
পর্তুগালের শহর গোন্দোমারের ইগ্রেজা মাত্রিজ গির্জায় জোটার শেষকৃত্য হয়। স্থানীয় সময় ১১টা থেকে শেষকৃত্যের কাজ শুরু হয়। এতে রুবেন নেভেস ছাড়াও অংশ নেন পর্তুগালের কোচ রবার্তো মার্তিনেজ, ব্রুনো ফার্নান্দেজ, বের্নার্দো সিলভা, রুবেন দিয়াস ও জোয়াও ফেলিক্সসহ আরও অনেকে। শেষকৃত্যে হাজির হয় লিভারপুলের গোটা দলও।
ফুলে মোড়ানো প্রিয় জোটার ২০ নম্বর জার্সি ও তার ভাই আন্দ্রে সিলভার ৩০ নম্বর জার্সি হাতে উপস্থিত হন লিভারপুল অধিনায়ক ভার্জিল ভ্যান ডাইক, অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার, অ্যান্ডি রবার্টসন, ওতারু এন্ডো ও কোচ আর্নে স্লটসহ অনেকে। শুধু এতেই থেমে যায়নি লিভারপুল। ক্লাবের সঙ্গে জোটার চুক্তির বাকি সময়ের সকল অর্থ তার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে লিভারপুল কর্তৃপক্ষ।
২০২২ সালে লিভারপুলে পাঁচ বছরের চুক্তি নবায়ন করেছিলেন জোটা। অর্থাৎ তার বর্তমান চুক্তির মেয়াদ ফুরোতে আরও দুই বছর বাকি ছিল। লিভারপুলে দিয়োগো জোটা সপ্তাহে আয় করতেন ১ লাখ ৪০ হাজার পাউন্ড, যেটা বছরে প্রায় ৭২ লাখ পাউন্ড। অর্থাৎ বোনাসের বাইরে শুধু পারিশ্রমিক হিসাবেই বাকি দুই বছরে প্রায় ১ কোটি ৪৫ লাখ পাউন্ড, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৪২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা পেতেন জোটা। লিভারপুল এই অর্থের পুরোটাই তার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, সমর্থকদের অনুরোধে জোটার পরা ২০ নম্বর জার্সি তার স্মরণে আজীবনের জন্য তুলে রাখারও ঘোষণা দিয়েছে ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
রাইভ্যালরি, কোন্দল- সব ভেদাভেদ ভুলে জোটার মাধ্যমে গোটা ফুটবল দুনিয়া এক হয়েছে। জোটার মৃত্যুর খবর সামনে আসার পর থেকেই অ্যানফিল্ডের বাইরে ভিড় জমিয়েছেন ক্লাবটির সমর্থকেরা। অর্ধনমিত রাখা হয়েছে ক্লাবের পতাকাও। জোটার স্মরণে ফুল হাতে চোখের জলে নীরবে জোটার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে শোক জানিয়েছেন তারা। শুধু লিভারপুলের সমর্থকই নয়, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও এভারটনের সমর্থকদের থেকেও মিলেছে জোটার প্রতি ভালোবাসা।
ক্লাব বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে গোল করার পর ফের জোটার স্মৃতি ফিরিয়ে আনেন ফুটবলাররা। বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে পিএসজির জয়ের দিনে গোল করেন ওসমান দেম্বেলে। এরপরই তিনি জোটার সেই আইকনিক গোল উদযাপন করেন। মাঠের একপাশে বসে আঙুল দিয়ে জয়স্টিক বা কনসোল গেমিং সেলিব্রেশন করেন দেম্বেলে। কারণ জোটা ছিলেন আগাগোড়া গেমিংপ্রিয় মানুষ, তাই গোল করলেও উদযাপন জুড়ে থাকত গেমিং। সেই উদযাপনকে এদিন মনে করান দেম্বেলে। শুধু দেম্বেলেই নয়, জোটার স্মৃতি মনে করিয়েছেন কিলিয়ান এমবাপ্পেও। ম্যাচের যোগ করা সময়ে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে দারুণ এক অ্যাক্রোবেটিক গোল করেন এমবাপ্পে। এরপর তিনি আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করেন ‘২০ সংখ্যা’। যা মূলত জোটার জার্সি নম্বর। এ নিয়ে ম্যাচ শেষে এমবাপ্পে বলেছেন, ‘এই গোল দিয়োগো জোটা এবং তার ভাইয়ের জন্য।’
ফুটবলারদের এমন আবেগঘন কর্মকাণ্ডে বারবার সমর্থকদের মাঝে ফিরে এসেছে জোটার স্মৃতি। জোটা যেন না থেকেও আছেন। কখনো স্বচক্ষে দেখা হয়নি, কখনো কথা হয়নি, তবুও দিয়োগো জোটার অকাল প্রয়াণে স্তব্ধ হয়েছে গোটা ফুটবল দুনিয়ার কোটি কোটি সমর্থক। সমর্থকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমজুড়ে ছিল কেবল একটি নাম- দিয়োগো জোটা।
ক্রিফোস্পোর্টস/৮জুলাই২৫/টিএইচ/এসএ
